আমার বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় একটা চায়ের দোকান রয়েছে। রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় লক্ষী দিদিকে ঐ দোকানে কাজ করতে দেখতাম। লক্ষী দিদি মানদা পিসির মেয়ে। মানদা পিসিকে আমি আমার মায়ের ডান হাত বলি। একা হাতে মানুষটা এক সময় কত দিক নীরবে সামলে গিয়েছে। অভাবের সংসার তাই পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা থাকলেও লক্ষী দিদি সেই অবকাশ পায়নি।
বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে যখন একমুখ হাসি নিয়ে সবাই মিলে দলবেঁধে স্কুলে যেতাম সেই দিনগুলোতেও দেখতাম লক্ষী দিদি ভাবলেশহীন মুখে নিজের কাজ করে চলেছে। একটা মানুষ এতটা নির্লিপ্ত ভাবে কি করে রোজ রোজ একই কাজ করতে পারে?- সেটাই বারবার ভেবেও কোন কূল কিনারা পেতাম না। পুজোর ছুটির আগে যেদিন শেষবারের মতোন স্কুলে যেতাম তখনো স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় দেখতাম লক্ষী দিদি ওই একই ভাবে নিজের কাজ করে চলেছে। সত্যি বলতে কি মনের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠতো মনে হতো সব আনন্দই মিথ্যে যদি না সেখানে লক্ষী দিদি থাকে; সুন্দর আমরা সবাই পুজোতে নতুন জামা পরবো, ঠাকুর দেখবো, ঘুরবো,মজা করবো আর লক্ষী দিদি......................?
আরে এইসব ভাবতে ভাবতে কবে যে এতটা বড় হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। এক সময় পণ করতাম দশের হয়ে দেশের জন্য কাজ করবো; আর এই ভাবনাটাই আমায় কবে যে একটা সাধারন মেয়ে থেকে রুপা, কুট্টি, চিন্টু, বাবলি, পূজা, রিংকু, পিংকি ওদের সবার স্বাধীনতা রক্ষার পাহারাদার বানিয়ে দিয়েছে তা যেন টেরই পাইনি।
লক্ষী দিদি স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি,পায়নি আর পাঁচটা কিশোরীর মতোন ওর মনের সুপ্ত বাসনার ক্যানভাস গুলোকে রঙিন করতে। আমি কেবলই লক্ষী দিদির মনের মধ্যে থাকা শব্দহীন যন্ত্রণা গুলোকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতাম মাত্র। আমি ওদের স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করি; চেষ্টা করি ওরা যাতে স্বাধীনতার স্বাদ পায় সেই দিকে নজর দিতে। ওরা স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে; স্বপ্ন দেখে একদিন ওরা মস্ত বড় মানুষ হবে দেশের দশের একজন হবে। ওরা জানে স্বাধীনতাটা একদিনের জন্য নয়; স্বাধীনতাটা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তের একটা স্বর্গীয় অনুভূতি যা নিহিত হয়ে আছে সবার আত্মার মধ্যেই। আর তাইতো ওরা বিশ্বাস করে সমষ্টির স্বাধীনতাই কেবলমাত্র স্বাধীনতা নয় স্বাধীনতা সকলের; সবার মধ্যে দিয়েই একমাত্র তাকে পাওয়ার পূর্ণতা লাভ করা যায়।
